মৃত ব্যক্তিরা হলেন—বয়রা সেরের বাজার মোড় এলাকার আব্দুর রবের ছেলে বাবু (৫০), বয়রা মধ্যপাড়ার আব্দুস সামাদের ছেলে সাবু (৬০), বয়রা জংশন রোডের বাসিন্দা গৌতম কুমার বিশ্বাস (৪৭), আজিবর (৫৯) এবং তোতা (৬০)। মৃত ব্যক্তিদের লাশ পরিবারের সদস্যরা বাড়িতে নিয়ে গেছেন।
এছাড়া, আরও একজন আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছেন। তিনি হলেন খালিশপুর দাসপাড়া এলাকার বাসিন্দা সনু। বর্তমানে তিনি খুলনা বিশেষায়িত হাসপাতালে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তার শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত সংকটাপন্ন এবং তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে।
ঘটনার বিষয়ে নিশ্চিত করেছেন সোনাডাঙ্গা মডেল থানার অপারেশন অফিসার এসআই আবদুল হাই। তিনি বলেন, "প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, নিহতরা বিষাক্ত মদ পান করেছিলেন। আমরা তদন্ত করছি কী ধরনের মদ তারা পান করেছিলেন এবং সেটি কীভাবে সংগ্রহ করা হয়েছিল।"
পুলিশ ও স্থানীয়দের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই মদ কোনো বৈধ উৎস থেকে কেনা হয়নি। এটি ছিল হাতেমালে তৈরি একটি বিষাক্ত তরল, যা ভারতের নিষিদ্ধ ‘এলকোলি’ নামক মেডিসিন দিয়ে প্রস্তুত করা হতো। সেই মেডিসিনে চুনের পানি ও ঘুমের ট্যাবলেট মিশিয়ে একটি নেশাদ্রব্য বানানো হতো।
পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, এই উপাদানগুলোর সংমিশ্রণ মারাত্মক বিষক্রিয়া সৃষ্টি করে, যা শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে তীব্র প্রভাব ফেলে। এতে শ্বাসকষ্ট, হৃৎপিণ্ডে সমস্যা, কিডনি ও লিভার অকেজো হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে।
একজন চিকিৎসক জানান, “এ ধরনের বিষাক্ত ও নিম্নমানের মদ খাওয়ার ফলে স্নায়ু এবং শ্বাসপ্রশ্বাসের কার্যক্রম দ্রুত বিকল হয়ে পড়ে। অনেক সময় রোগীকে হাসপাতালে আনার আগেই মৃত্যু ঘটে।”
এই ঘটনায় বয়রা, দাসপাড়া ও আশপাশের এলাকায় চরম উদ্বেগ ও আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। এলাকাবাসী বলছেন, দীর্ঘদিন ধরেই স্থানীয়ভাবে কিছু অসাধু ব্যক্তি বিষাক্ত মদ তৈরি করে বিক্রি করে আসছে। তারা প্রশাসনের নজর এড়িয়ে গোপনে এসব মদ মজুত ও বিক্রি করে।
একজন স্থানীয় বাসিন্দা জানান, “বেশ কয়েকবার আমরা প্রশাসনকে জানিয়েছি যে এলাকায় ভেজাল মদ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আজকের ঘটনায় পাঁচজনের প্রাণ গেছে, এরপরও যদি প্রশাসন না জাগে, তাহলে আরও প্রাণহানির ঘটনা ঘটবে।”
এই ঘটনায় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অনেকেই বলছেন, নিয়মিত নজরদারি ও অভিযান না থাকার কারণেই এমন ঘটনা ঘটছে। অবৈধভাবে ভারতীয় মেডিসিন ‘এলকোলি’ কীভাবে দেশে প্রবেশ করছে এবং স্থানীয়ভাবে এর ব্যবহার কাদের দ্বারা হচ্ছে—তা খুঁজে বের করতে হবে।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, “ঘটনার পর আমরা এলাকায় তদন্ত শুরু করেছি। কে বা কারা এই মদ সরবরাহ করেছে, তা খুঁজে বের করা হবে। এ ধরনের বিষাক্ত মদ যারা তৈরি ও বিক্রি করছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
নিহতদের পরিবারে চলছে শোকের মাতম। তারা বলছেন, প্রিয়জনের এমন মৃত্যু মেনে নেওয়া কঠিন। অনেকেই কাজ করে সংসার চালাতেন। তাদের অকাল মৃত্যুতে পরিবারে বিপর্যয় নেমে এসেছে।
মৃত বাবুর স্ত্রী কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, “সে মাঝে মাঝে একটু খেত, কিন্তু এমন কিছু হবে ভাবিনি। আমার ঘরটা এক নিমিষে শেষ হয়ে গেল।”
চিকিৎসকরা বলছেন, ভেজাল মদ বা রাসায়নিক দ্রব্য মিশ্রিত তরল পান করা জীবনঘাতী হতে পারে। কোনো অবস্থাতেই অজানা উৎস থেকে মদ বা কোনো ধরনের তরল নেশাদ্রব্য গ্রহণ করা উচিত নয়।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের একজন চিকিৎসক বলেন, “বাজারে অনেক সময় লোকাল তৈরি মদ পাওয়া যায়, যেগুলোর উৎস অজানা। এসব মদে মিথানল, ঘুমের ওষুধ, এমনকি কীটনাশক পর্যন্ত মেশানো হয়। এটি শরীরের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক।”
খুলনায় পাঁচজনের প্রাণহানির এই ঘটনা শুধুই একটি দুর্ঘটনা নয়, বরং একটি গভীর সামাজিক ও প্রশাসনিক সংকটের প্রতিফলন। মদের নামে বিষ সেবনের এই প্রবণতা যদি এখনই বন্ধ না করা যায়, তবে আরও অনেক প্রাণ ঝরে পড়বে এভাবে। প্রয়োজন কঠোর প্রশাসনিক পদক্ষেপ, সামাজিক সচেতনতা এবং অবৈধ মদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান।
এখনই সময়, সরকার ও প্রশাসনের কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার। অন্যথায়, খুলনার এই কান্না শুধু একটি এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না—এটি ছড়িয়ে পড়বে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।