খুলনায় বেকারত্বের বর্তমান অবস্থা ও দূরীকরণে করণীয়

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্যতম প্রধান বিভাগীয় শহর খুলনা, যার অর্থনৈতিক ভিত্তি কৃষি, মৎস্য, ক্ষুদ্র ব্যবসা ও সরকারি চাকরিকেন্দ্রিক। অথচ গত এক দশকে এই অঞ্চলে শিল্পায়নের গতি কমে যাওয়ায়, কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে গেছে এবং বেকারত্ব একটি বড় সমস্যা হিসেবে সামনে এসেছে। খুলনা শহর ও জেলার আর্থসামাজিক অবস্থা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তরুণ সমাজ বিশেষত শিক্ষিত যুবক ও নারীরা দিন দিন কর্মহীনতায় নিমজ্জিত হচ্ছে। COVID-19 মহামারির পর এই পরিস্থিতি আরও জটিল রূপ ধারণ করেছে।

জাতীয় প্রেক্ষাপটে বেকারত্ব

বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বর্তমানে দেশে বেকারত্বের হার প্রায় ৪.৬৮ % (২০২৪ সাল পর্যন্ত)। এই হার যদিও অনেক উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় তুলনামূলক কম, তবে কর্মসংস্থানের গুণগত মান, আয়ুষ্কাল ও চাকরির নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ। বিশেষ করে নতুন গ্র্যাজুয়েটরা চাকরি না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়ছে।

২০২২ সালের জাতীয় শ্রমশক্তি জরিপ অনুসারে, বাংলাদেশে প্রায় ৪০ লক্ষ তরুণ-তরুণী উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করার পরও বেকার অবস্থায় আছে। এর মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মধ্য থেকে ৬৬ % বেকার থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। খুলনাও এই জাতীয় প্রবণতার বাইরে নয়।

খুলনার অর্থনৈতিক কাঠামো ও বেকারত্ব

খুলনার অর্থনীতির বড় অংশ এখনো কৃষি ও ক্ষুদ্র ব্যবসাভিত্তিক। Inspira BD-এর একটি সাম্প্রতিক গবেষণা রিপোর্ট অনুযায়ী খুলনার কর্মজীবী জনগণের মধ্যে ৩৪.৯ % কৃষিতে নিয়োজিত, ১৯.৬ % ব্যবসা, ১৮.৩ % সেবাখাতে এবং মাত্র ৩.৫ % মানুষ শিল্প খাতে কাজ করছে। এই পরিসংখ্যান ইঙ্গিত দেয় যে শিল্পায়নের দিক দিয়ে খুলনা এখনো পিছিয়ে।

শিল্প খাতের অবক্ষয়

খুলনা একসময় দেশের অন্যতম শিল্প নগরী হিসেবে পরিচিত ছিল। খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল, খুলনা হার্ডবোর্ড মিল, দৌলতপুর জুট মিলসহ একাধিক বৃহৎ সরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠান এ অঞ্চলে ছিল। কিন্তু ৯০’র দশক থেকে ধারাবাহিকভাবে এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বহু মানুষ বেকার হয়ে পড়ে। এর ফলে নতুন প্রজন্মের কর্মসংস্থানের সুযোগও সংকুচিত হয়ে পড়ে।

মহামারির প্রভাব

২০২০ সালের COVID-19 মহামারির সময় খুলনায় আনুমানিক ২০,০০০ জন মানুষ চাকরি হারায়। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ায় আরও প্রায় ১৫,০০০ জন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় পড়ে। পর্যটন, খুচরা বিক্রয়, হোটেল-রেস্টুরেন্ট ও সেবাখাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষুদ্র ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত বহু পরিবার আয়হীন হয়ে পড়ে।

নারী ও তরুণদের চাকরির চ্যালেঞ্জ

খুলনায় নারীদের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার তুলনামূলকভাবে কম। রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থা, পর্যাপ্ত নিরাপদ কর্মপরিবেশের অভাব, এবং দক্ষতা ঘাটতির কারণে বহু নারী ঘরে বসে থাকেন। অপরদিকে, তরুণদের মধ্যে উচ্চশিক্ষা শেষে চাকরির নিশ্চয়তা না থাকায় হতাশা বাড়ছে। অনেকে বিদেশগমনের চেষ্টা করে, কেউ কেউ আবার উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখে নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ে ব্যর্থ হন।

ব্র্যাকের মতে, খুলনায় শিক্ষিত তরুণদের জন্য Career Hub চালু করা হয়েছে। এই প্ল্যাটফর্মটির মাধ্যমে কর্মসংস্থানের গাইডলাইন, স্কিল ডেভেলপমেন্ট ও চাকরি সংযোগ প্রদান করা হচ্ছে। তবে এটি এখনো সীমিত পরিসরে চালু রয়েছে।

খুলনায় চাকরি ও স্কিল ঘাটতির ফাঁক

খুলনায় বেকারত্ব বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হলো দক্ষতার ঘাটতি। স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কারিগরি বা চাকরি-বান্ধব শিক্ষা দেওয়া হয় না। যার ফলে চাকরিপ্রার্থীরা বাস্তব কর্মজগতে প্রবেশ করতে পারে না।

এ ছাড়া খুলনায় আইটি ও সফট স্কিল ভিত্তিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অভাব রয়েছে। ফলে ফ্রিল্যান্সিং, রিমোট জব, বা স্টার্টআপ কালচারের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বর্তমান শ্রম বাজারে কেবল একাডেমিক ডিগ্রি দিয়ে চাকরি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।

খুলনায় উন্নয়ন কার্যক্রম ও সম্ভাবনা

বর্তমানে খুলনায় কিছু নতুন অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও শিল্প সম্ভাবনার দ্বার খুলছে। যেমন:

  • সুন্দরবনের পর্যটন শিল্প সম্প্রসারণ

  • পায়রা বন্দরের সড়ক সংযোগ খুলনার দিকে সম্প্রসারণ

  • নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির প্রস্তাব

  • ছোট ছোট আইটি ফার্ম ও গার্মেন্টস ইউনিট স্থাপন

এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হলে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। তবে এসব উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সরকারের আন্তরিকতা, বিনিয়োগ আকর্ষণ ও দক্ষ মানবসম্পদের সংযোগ প্রয়োজন।

করণীয় ও সুপারিশ

খুলনার বেকারত্ব সমস্যা সমাধানে নিচের সুপারিশগুলো গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে:

১. দক্ষতা ভিত্তিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ

কারিগরি শিক্ষা, আইটি প্রশিক্ষণ ও সফট স্কিল ভিত্তিক কর্মসূচি সম্প্রসারণ করতে হবে। তরুণদের লক্ষ্য করে আলাদা স্কিল ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট স্থাপন জরুরি।

২. উদ্যোক্তা সহায়তা কেন্দ্র

স্থানীয় উদ্যোক্তাদের জন্য ক্ষুদ্র ঋণ, ট্রেনিং, আইনি সহায়তা ও পরামর্শক সেবা প্রদান করতে হবে, যাতে তারা নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারে।

৩. নারী কর্মসংস্থান সহায়তা

নারী উদ্যোক্তা ও চাকরিপ্রার্থীদের জন্য আলাদা কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। নিরাপদ কর্মপরিবেশ এবং শিশুকেয়ার সেন্টারের ব্যবস্থা থাকলে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়বে।

৪. স্থানীয় শিল্পায়ন ও বিনিয়োগ আকর্ষণ

সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে খুলনায় শিল্প অঞ্চল বা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (SEZ) গড়ে তোলা উচিত।

৫. বেকার তথ্যভান্ডার ও ডেটা ব্যাংক

জেলায় একটি আধুনিক বেকার তথ্যভান্ডার বা অনলাইন রেজিস্ট্রি চালু হলে চাকরিদাতারা উপযুক্ত প্রার্থী খুঁজে পেতে পারবে এবং বেকাররাও সুযোগ খুঁজে পাবে।

খুলনা বাংলাদেশের একটি সম্ভাবনাময় শহর। সুন্দরবন, নদীবন্দর, কৃষি এবং শিল্প–সব মিলিয়ে খুলনার অর্থনীতি বহুমুখী ও বৈচিত্র্যময়। তবে পরিকল্পনার অভাব, শিল্পের পতন এবং দক্ষতার ঘাটতির কারণে এখানকার বেকার সমস্যা দিন দিন প্রকট হচ্ছে। সমন্বিত উদ্যোগ, শিক্ষিত ও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি এবং টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনার মাধ্যমে খুলনায় কর্মসংস্থান বৃদ্ধির দার খুলে দেওয়া সম্ভব। সরকারি, বেসরকারি এবং স্থানীয় জনগণের সমন্বয়ে একটি বিস্তৃত কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হলে খুলনা আবার কর্মচাঞ্চল্যে ভরপুর একটি শিল্প ও সেবাকেন্দ্রিক শহরে পরিণত হতে পারে।

[রেফারেন্স সূত্র]

  • Inspira-BD.com, ২০২৪

  • BRAC.net Career Hub, ২০২২

  • MacroTrends, World Bank data, ২০২4

  • Labour Market Profile: Bangladesh 2024, Ulandssekretariatet

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন